সোনিয়া মারমেলাডভ
নাম তাঁর সোনিয়া। মা-বাবার দেয়া নয়, নিজেরই দেয়া। অনেক পরে আবিষ্কার করেছিলাম, দস্তয়ভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিসম্যান্টের চরিত্র, পতিতা সোনিয়ার নামটিই সে বেছে নিয়েছিল। আমার সাথে তাঁর যেটুকু যোগাযোগ, তাতে সোনিয়া ভিন্ন অন্য কোন নামের প্রয়োজন নেই। কৌতুহলে একবার পুরো নাম জানতে চেয়েছিলাম। উত্তর ছিল, ভোঁতা এবং কৌতুক বিবর্জিত।
– সোনিয়া সেমিওনোভা মারমেলাডভ।
দস্তয়ভস্কির সোনিয়ার পতিতাবৃত্তি ছিল, মাতাল পিতার সংসার চালানোর জন্য। কিন্তু এই সোনিয়ার ব্যাপারটি তেমন ছিলো না। সে বেশ সচ্ছ্বল পরিবার থেকে এসেছে। দস্তয়ভস্কির সোনিয়া আর তাঁর মাঝে একটাই মিল, তা হলো, তাঁরা দু'জনেই বিছানায় যেতো সঙ্গী পুরুষটিকে ভালো না বেসেই।
সম্ভবত: অন্য যে ক'জন ছেলেবন্ধু, যাদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, সবার কাছেই সোনিয়া কেবল সোনিয়াই।
সোনিয়া সম্পর্কে আমি যে টুকু জানি, তা খণ্ড চিত্র। অথবা খন্ড খন্ড চিত্রের কোলাজ। সোনিয়ার একবার বিয়ে হয়েছিল। ভূতপূর্ব স্বামী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। দু'হাতে ঘুষ খেতো। ঘুষের টাকা রিয়েল এস্টেটে ইনভেস্ট করে আরো ফাঁপিয়ে নিয়েছিলো। সোনিয়া চাইলে, অর্থের ভাবনাহীন একটা জীবন বেছে নিতে পারতো। কিন্তু সোনিয়া সেই জীবনটি বেছে নেয় নি। এই জীবনটি বেছে নিয়েছিল । সোনিয়ার ভাষায়, সে সুখী।
"সুখ নিজের মানসিক অবস্থা উপর নির্ভর করে। ঘর হলো না, সংসার হলো না, এই বিলাপ থেকে বাইরে এলেই, এসকর্টও সুখী হতে পারে।"
আমি সোানিয়াকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সুখের রহস্য কি?
সোনিয়ার উত্তর , স্বাধীনতা। আমার শরীরের স্বাধীনতা। আমার জরায়ুর স্বাধীনতা। অ্যান সাক্সটোনের কবিতার লাইন আউরে বলে, আই ওয়াজ টায়ার্ড অফ বিয়িং উইম্যান।
– আপনি তো এখনো নারীই আছেন।
– কিন্তু আমি আর ক্লান্ত নই, আগের মতো।
সোনিয়ার সাথে কেমন করে, কখন , কি কারণে দেখা হয়েছিল, তার একটা গল্প আছে। গল্পটিতে কিছু কৌতুকও রয়েছে।
আমি এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ কাজ করি। বস রেহনুমা, চারুকলার ছাত্রী ছিলেন। বেশ আধুনিকাই। পোষাকে আশাকে। চাল চলনে। সবকিছুতেই একটা ড্যাশিং ভাব। কারণ - অকারণে খিস্তি খেউর যপে। কাজ বিষয়ক পরিভাষাগুলোতে এক ধরণের কামজাগানিয়া শব্দ ব্যবহার করে।
যেমন ধরুণ, ডিজাইনারদের বুঝোনোর জন্য বলবে, এরকম নয়, আই নিড অ্যা সেক্সি ভিজুয়াল। কোন আইডিয়া পছন্দ না হলেই বলতো, আই ডোন্ট নিড এ বোরিং ফাকড্ আপ আইডিয়া। আই নিড এ ফ্রেশ ভার্জিন আইডিয়া। ভার্জিন শব্দটায় বেশ জোর দিয়ে বলে সে। ভার-জিন। যেন সে আসলেই ক্লায়েন্টেদের জন্য অক্ষতযোনী কুমারী মেয়েই চাইছে। এই ভার্জিন আইডিয়ার খপ্পরে পড়ে, দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়। আমরা যে আইডিয়াই দেখাই, প্রায় সবই রেহনুমার কৌমার্যের পরীক্ষায় ফেল। এহেন অত্যাচারে রেহনুমার ভার্জিন শব্দটার প্রতি এক ধরণের ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।
একদিন এক ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং-র পর, রেহনুমা খোশ্ মেজাজে। আমাকে খাওয়াতে একটা রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেলো। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, " তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে?"
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম , না।
– আগে ছিল?
– না।
এবার একান ওকান প্রসারিত হাসি দিয়ে বললো, তাইলে তো তুমি একটা ইউজলেস ভার্জিন।
তারপর রেহনুমা একটা কৌতুক শোনালো। কৌতুকটি এই রকম:
এক ত্রিশোর্ধ পাত্র, সম্ভাব্য পাত্রীর সাথে দেখা করতে গেছে। আলাপের এক পর্যায়ে, পাত্রী জিজ্ঞেস করলো, সেই ত্রিশোর্ধ্ব পাত্রের আগে কোন গার্লফ্রেন্ড ছিলো কিনা।
পাত্র না সূচক উত্তর দেয়।
সঙ্গে সঙ্গেই , পাত্রীর উত্তর, " যে ত্রিশোর্ধ্ব ছেলে, সারা জীবনে কারো কোন মেয়ের কোন কাজে আসে নি, আমার কি কাজে আসবে?"
এক চামচ স্যুপ মুখে দিতে দিতে রেহনুমার সে কি অদম্য হাসি।
রেহনুমার তীর্যক কৌতুক, অন্তত: দু'টি বিষয় আমার সামনে আয়নার মতো মেলে ধরলো, তার একটি হলো, আমি একজন ব্যাচেলর। নারীর প্রতি স্বভাব সুলভ আকর্ষণ আমার আছে। কম কি বেশী, তা মেপে দেখতে সক্ষম হই নি। মাপার মতো নিক্তিও ছিল না। নারীর সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে, শুধু এই টুকু বলতে পারি।
আমার পিতা-মাতা একসাথে দীর্ঘদিন একসাথে বাস করছেন। তাঁরা আলাদা ভাবে দারুণ পিতা অথবা মাতা। কিন্তু তাঁদের পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখে আমার বার বার মনে হয়েছে, এমন একটি জটিল সম্পর্ক সৃষ্টি করার জন্য বিয়ে করার কিই বা মানে হয়? তাছাড়া, ছোটবেলা থেকে এতো বেশী যুযুধান , সমস্যাসংকুল দাম্পত্য দেখেছি, বিয়ে প্রথাটি আমাকে খুব একটা টানে না। মানুষের জীবনে যতগুলো সম্পর্ক আছে, তার মাঝে সবচেয়ে যান্ত্রিক হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। একবার এক বন্ধুর স্ত্রী, ফেসবুকে ঘোষণা করলো, তার স্বামী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী। ভাবলাম, বাহ্, এমন লোকও আছে তবে! তিন মাস পর শুনি, বন্ধুর স্ত্রী আরেকজনের সাথে পালিয়ে গেছে।
অনেক বন্ধুকে, বিয়েতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি, শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্কের সমাজ-সিদ্ধ দ্বিতীয় কোন পথ নেই বলে। অনেকে বিবাহিত জীবনে ভালোই আছে। কিন্তু বিয়ে অনেকটা, খুঁদে পানায় ঢাকা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো। পানার নিচে কি অপেক্ষা করছে তা কেউ জানেন না। আমাদের দেশে আইন সম্মতভাবে কৌমার্য বিসর্জনের একমাত্র উপায় বিয়ে। বিভিন্ন মহল থেকে আমার বিয়ের ঘরও এসেছিল, সযত্নে এড়িয়ে যাওয়ার মতো সবল কারণ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।
রেহনুমার আয়নাটি দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমার চোখে তুলে ধরলো, তা হলো, আমি কুমার। আমি টের পাই, আমি জৈবিক ভাবে সক্ষম। আমি সহজাত এক আকর্ষণকে অবদমন করে রেখেছি। প্রশ্ন হলো , কেন? ভার্জিনিটি আমাদের সমাজে একটা স্টিগমার মতো। যদিও মেয়েরাই এই স্টিগমার অধিক শিকার। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে বেড়ে উঠা কোন ছেলের পক্ষেও এই স্টিগমার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। যতই অবদমিত হোক, মানুষের শরীর এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের সমাজে, শরীর এক নিষিদ্ধ বস্তু। আমাদের সমাজ বিবাহের বাইরে শারীরিক সম্পর্ককে অপবিত্র বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই ভার্জিনিটির সাথে , পবিত্রতার এক সম্পর্ক আছে। কেউ চাক বা না চাক, সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তার উপর ভার্জিনিটি নামক ট্যাবুটির প্রভাব বিদ্যমান। আমার এক মহা প্রগতিশীল বন্ধু, বিয়ের কিছু পর, আমাদের সাথে মদ খেতে বসে, হাউমাউ করে কাঁদছিল। কারণ সে জানতে পেরেছিল, তার বউ ভার্জিন নয়।
তাই আমাদের সমাজে বেড়ে উঠা , একজনকে এই ট্যাবু থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ কোন পথ নেই। আমি ভেবে দেখেছি, যদিও আমার কৌমার্যের পেছনের কারণ সুস্পষ্ট নয়, তবে ভার্জিনিটি নামক ট্যাবুটির একটি ভূমিকা থাকতে পারে। আমি রেহনুমার আয়নায় দেখানো দ্বিতীয় বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আমার কাছে কৌমার্য ধরে রাখার বিষয়টিকে নিরর্থক মনে হলো। আমি এটি বিসর্জন দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ব্যাপারটি এমন নয় যে, আমি কাল গিয়ে, ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত তোলার মত করে , কৌমার্য বিসর্জন দেবো। আর নিভৃতচারী যুবকের পক্ষে, বিবাহের বাইরে গিয়ে, এই কর্মটি করা ভীষণ রকম স্নায়ুক্ষয়ী এক বিষয়। আমি বরং অপেক্ষায় থাকলাম। যদি সুযোগ আসে , তবে আমি তা ফিরিয়ে দেব না।
সোনিয়ার ফোন নাম্বারটি পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। বন্ধুটিকে আমরা 'ভন্ড শুভ' বলে ডাকতাম। ভালো ছাত্র, ভালো চরিত্রের অধিকারী বলে ব্যাপক সুনাম ছিলো আন্টি মহলে। পোষক দেহ পেলেই, ভাইরাস যেমন, জীবন্ত হয়ে উঠে, তেমনি রাত্রি হলেই 'ভন্ড শুভ'-র অশুভ এন্টিনাগুলো সচল হয়ে উঠতো। তার বেশ কিছু রাত্রীকালীন ফোনালাপের বান্ধবী ছিলো। তবে সে ছিলো নীতিবান। তার দৌড় ফোনালাপ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতো। আমাকে সোনিয়ার ফোন নাম্বারটি দিয়ে বলেছিল, সাহিত্যিক টাইপের মেয়ে, এর সব কথা আমার এন্টিনার উপর দিয়া যায়। এক্কেবারে তোর মতো আধ্যাত্মিক!
অপরিচিত এক নারীকে মাঝ রাতে ফোন করবো, আমি সংকোচ বোধ করছিলাম। তবু ফোন করলাম। ফোন ধরলো সোনিয়া। আমার নাম বলে পরিচয় দিলাম। কথা বলতে চাইলাম। কি কথা . তা জানতে চাইলো না। কার কাছ থেকে তার ফোন নাম্বার পেলাম , তাও জানতে চাইলো না। সহজ সাধারণ ভাবে কথা শুরু হলো। মাঝে মাঝেই আমরা রাতে কথা বলতে শুরু করলাম। সুরেলা, মসৃণ কোন কণ্ঠ নয়। বলা ভালো, এক ধরণের খসখসে কণ্ঠ। শুরুতে একটু বেসুরো মনে হলেও, ধীরে ধীরে টের পেলাম, কন্ঠস্বরের মাঝে এক ধরণের নেশা মেশানো আছে। শচীন কর্তার গানের মতো, উদ্ভট গলা, কিন্তু একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, ভিন্নতার আকর্ষণ তৈরী হয়। ওকাল্ট ভয়েজ।
কথা বলে ধীর স্থির ভঙ্গিতে। চপলতা বা তাড়াহুড়ো নেই। শব্দ চয়নে অসম্ভব বুদ্ধির ছাপ। পরিমিত মেদ ঝড়ানো বাক্যালাপ। হিউমার সেন্স ভীষণ সুক্ষ্ম। স্বাভাবিক কোন চটুল কৌতুক নয়। গভীর রসবোধ। নিজস্ব একটা স্টাইলে, এমন ভাবে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয়, যেন মহাভারতের অর্জুনের 'একাগ্নি বাণ'।
সোনিয়া যেন আগে থেকেই জানতো, আমাদের রাত্রীকালীন ফোনালাপের গন্তব্য কোথায়। আমার কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নেয়ার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। সোনিয়াই উদ্ধার করলো। সোনিয়া বললো, আমাদের দু'জনের মাঝে সাক্ষাৎ হওয়া উচিত। বদ্ধ স্থানে আমার এমনিতেই দমবন্ধ লাগে। তার উপর এক স্বল্প পরিচিত এক নারী, যার সাথে আমার আপতকালীন প্রণয়ের সম্ভাবনা আছে, এমন একজনের সাথে দেখা করতে হবে। আমি প্রাণান্তকরণে চাইছিলাম, কোন এক খোলা জায়গা দেখা হোক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে. উদ্যানে অথবা লেকের ধারে।
সোনিয়া বললো , না।
একটু কৌতুক করে বললাম. লোকচক্ষুর ভয়?
সোনিয়া জানালো, লোকচক্ষু অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছে। এখন যেটুকু ভয় আছে তা হলো, খোলা আকাশের।
খোলা আকাশকে কেন ভয় পায়, তা জানতে চাওয়ার আগেই, সে এক কফিশপের নাম প্রস্তাব করে। আমি রাজি হয়ে যাই ।
তারিখ, দিন, সময় হিসেব করে , একটু আগেই পৌঁছে যাই। এই কফি শপটির বিশেষ বৈশিষ্ট হলো, এর আভ্যন্তরীন সজ্জা। যে এই স্থানটিকে সাজিয়েছে, তার নিশ্চিত পাশ্চাত্যের শিল্পকর্মের প্রতি ব্যাপক মোহ রয়েছে। ইউরোপের বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর প্রোটো টাইপ, কফিশপের বিভিন্ন দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এবং প্রতিটি ছবির নীচে, ছবি ও শিল্পী সম্পর্কে কিছু বর্ণনা আছে ইংরেজীতে। সহজেই অনুমেয়, ইংরেজী শিক্ষিত হাই-এন্ড কাষ্টমারদের টার্গেট করেই এই কফির দোকানটি খোলা। ছবিগুলোর বেশ কিছু আমারও প্রিয়। পিকাসুর গোয়ের্নিকা, ভিঞ্চির মোনালিসা, ভ্যানগগের স্টারি নাইট, সানফ্লাওয়ার। ইম্প্রেশানিষ্টদের কিছু ছবি।
আমি মোনালিসার পাশে গিয়ে ,একটা দু'চেয়ারের টেবিলে বসে অপেক্ষা করি। হাতের মোবাইলে ফেসবুক চালাই। ছুটির দিন। সকাল দশটা। লোকজন বেশী নেই। চেয়ারগুলো ফাঁকা। গোল টেবিলের উপর , পোরসেলিনের ফুলদানীতে দু'তিনটে গোলাপ , আর একটা গ্লাডিওলাসের স্টিক, হালকা কমলা রঙের। গ্লাডিওলাসের গন্ধ নেই। গোলাপের নিশ্চয়ই গন্ধ আছে। কিন্তু কফির কড়া গন্ধে, অন্য কোন গন্ধ পাবার উপায় নেই। এই উৎকট কফির গন্ধের মাঝে, এই বিখ্যাত ছবিগুলোকে 'আউট অব প্লেস' মনে হলো। মনে হচ্ছিলো, মোনালিসা যেন ছবি থেকে বেড়িয়ে এসে এখনই পালাবে। এই কফির গন্ধের সাথে, এলভিস প্রিসলি, মাইকেল জ্যাকসন, প্রমূখের ছবিই বেশী মানানসই হতো।
সোনিয়ার আসার সময় যত এগিয়ে আসে, উৎকন্ঠাও বাড়তে থাকে। বুকের ঠিক নিচে এক ধরণের আজব অনুভূতি। বার বার দরজার দিকে তাকাই। সোনিয়া বলেছে, সে এসে ফোন দেবে।
'আপনি উন্মেষ?' পেছন থেকে জানতে চাইলো একটি কণ্ঠস্বর।
ঘুরে দেখার আগেই বুঝলাম, কণ্ঠটি কার। প্রথম বারের মতো সোনিয়ার সাথে দেখা হলো। দীঘল ও ঋজু দেহকাণ্ড, ধারালো চিবুক, কান ও চিবুকের খানিক ঢেকে দেয়া রেশমী চুল , ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। অযথা সাজার কোন চেষ্টা নেই। ন্যুনতম সাজ-সজ্জা। কৃত্রিম ভাবে ভ্রুকেও সাজানো হয় নি। লাল রঙের এক আঁটো-সাঁটো স্যালোয়ার, লাল সাদা কামিজে বুকের উপর এব্রয়ডারীর কাজ। দৃষ্টিতে কোন সংকোচ নেই। এক টুকরো কৌতুক জাগানিয়া হাসি। মনে হলো, আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও, তাঁর ভাবনা অন্য কোথাও।
আমার সামনের চেয়াটিতে বসলো। বাঁদিকে তাকালো। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে, আমিও তাকালাম। নীল আকাশ। ছেঁড়া ছেঁড়া পালক মেঘ। যেন এখনই টুপ করে খসে পড়বে।
সোনিয়া বললো, চলুন , আমরা আরেকটু ভেতরে গিয়ে বসি।
টেবিল পরিবর্তন করে বসলাম। এখান থেকে আর আকাশ দেখা যায় না।
এবার সুযোগ পেলাম। জানতে চাইলাম আকাশকে কেন এতো ভয়?
-- আসলে খোলা আকাশ আমার খুব ভালোই লাগে। তবে কেউ সাথে থাকলে, আমি আকাশ দেখি না। আমি চাই না, মন ডানা মেলে সে আকাশে উড়ুক।
মাত্র তিনটি বাক্যে সোনিয়া আমাদের সম্ভাব্য সম্পর্কের সীমানা এঁকে দেয়।
মেনু দেখে দু'কাপ কফির অর্ডার করে সোনিয়া। তার আগে জেনে নেয়, কফির সাথে আমি অন্য কিছু নেব কিনা। মনে হলো , এই কাজে সে অভ্যস্ত।
জিজ্ঞেস করলাম, প্রায়ই আসেন এখানে?
-- না। আমি একই জায়গায় দ্বিতীয়বার না আসার চেষ্টা করি। যদিও আসি, তবে কমপক্ষে ছয় মাসের একটা বিরতি থাকে।
আমরা কফির জন্য অপেক্ষা করি।
সোনিয়ার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে। অনেক বিষয় নিয়ে। কখনো, বিষয়ের অভাবে কথা থেমে থাকে নি। কিন্তু সামনা-সামনি মুখোমুখি বসে যেন কথা খুঁজে পাই না। অল্প দু'একটা কথা বলার পরই থেমে যাই, দু'জনই। আবার নতুন বিষয় খুঁজতে হয়। এভাবে ডিজেল-পূর্ব যুগের অ্যাজমা আক্রান্ত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মতো আলাপচারীতা চলে।
দু'মগ কফি আসে। কফির উপরিভাগে ভালোবাসার চিহ্ন। জানি না , এরা কি কৌশলে এটি করে। সোনিয়া ভালোবাসা চিহ্নটির দিকে তাকায়। নিজের মগটি টেনে নেয়, তারপর ফুঁ দিয়ে ভালোবাসার চিহ্নটি এলোমেলো করে দেয়। সোনিয়ার ভালোবাসা বিরোধী আচরণটি বেশ প্রকট। যেন সর্বতোভাবে সম্পর্ক, মনের ব্যাপারটি এড়িয়ে চলতে চায়। আমার কাছে মনে হয়, ভালবাসায় জড়িয়ে না পরার যুদ্ধটি, অনেকটা নিজের সাথে নিজের।
আমরা মিনিট ত্রিশেক মুখোমুখি বসেছিলাম। তাল ছন্দ বিহীন গানের মতো, উদ্দেশ্যবিহীন অগুরুত্বপূর্ণ কথা হয়। রাতে ফোনে কথা হবে বলে. যার যার পথে রওনা দিই।
রাতে আমি ফোনের জন্য অপেক্ষায় থাকি। এক ধরণের শংকা কাজ করে । মনে হয়, ফোনের বাইরে, আমাকে দেখে সোনিয়া কিছুটা হতাশ।
সোনিয়া ফোন করে। আমাদের কথা শুরু হয়। স্বত:স্ফূর্ত। ঠিক আগে যেমন করে কথা হতো, ঠিক তেমনই। দুপুর বেলার ছন্দহীন কথোপকথনের কোন প্রভাব নেই। যেন যা ঘটেছে, তা ভীষণ প্রত্যাশিত। আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম, তার ডানদিকের দেয়াল বতিচেলি'র ভেনাসের জন্ম ছবিটি নিয়ে আলাপ হয়। ছবিটির স্টাইল , টেকনিক নিয়ে কথা হয়। নগ্নতা , অশ্লীলতা নিয়ে আলাপ হয়। হেলিনিস্টিক স্টাইলে , কেন চুল দিয়ে, নগ্ন নারীর যৌনাঙ্গ ঢাকা থাকতো, তা নিয়েও কথা হয়।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ , সোনিয়া কফিশপের ছন্দহীন কথোপকথনের বিষয়টি টেনে আনে। " আপনি বোধ হয় খেয়াল করেছেন, আমি ভীষণ আড়ষ্ট ছিলাম।"
-- আমিও খুব স্বত:স্ফূর্ত ছিলাম না।
সোনিয়া তার আড়ষ্টতার কারণটি ব্যখ্যা করে। প্রথম বারের মতো, সে ব্যক্তিগত একটি বিষয় জানায়। সে পেশায় একজন ডাক্তার। কোন স্পেশালিটির সেটি বলে না। পাবলিক প্লেসে, কোন রোগী অথবা পরিচিত জনের সম্ভাব্য উপস্থিতি তাকে বিব্রত করে। মনে হয় , কেউ যেন তাকে দেখছে। তাই সে পাবলিক প্লেসে কোন ছেলে বন্ধুর সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না।
– এভাবে দেখা না করলেই হতো!
– আপনি নিশ্চয়ই, অভিসারে গিয়ে এমন কাউকে দেখতে চাইবেন না, যার প্রতি আপনি শারীরিক ভাবে আকর্ষণ বোধ করেন না। তাই অন্তত: একবার দেখা হওয়াটি জরুরী ছিল।
সোনিয়া-চরিতের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো, সে ভীষণ সরাসরি কথা বলে। 'বিটিং এরাউন্ড বুশ'-এর ধারে কাছে যায় না। যদি এক কথায় আমাদের কফি পর্বের কারণ বলতে বলা হয়, তবে উত্তর হবে, একের প্রতি অন্যের 'সেক্স এপীল' যাচাই করে নেয়া। যদিও কৌমার্য বিসর্জনের বিষয়টি মাথায় নিয়েই , আমি সোনিয়ার সাথে কথা বলতে শুরু করে ছিলাম। তবু অভিসারের কথা শুনে, গলায় কি যেন আটকে গেল। নি:শব্দে ঢোঁক গিললাম।
সোনিয়া অভিসারের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলে, তা বলে দিল। কোন খোলা জায়গায়, পার্কে বা রেঁস্তোরায় আমাদের আর দেখা হবে না। তাই প্রতিটি সাক্ষাতই হবে, চার দেয়ালের ভেতর। যদি কখনো দেখা হয়ে যায় কোথাও, তবে না চেনার ভান করতে হবে।
সোনিয়া এক মাসে কোন ছেলের সাথে দু্ই বারের বেশী সাক্ষাৎ করে না। আর কোন নির্দিষ্ট ছেলের সাথে সে টানা তিনবার দেখা করে না। দুই বার দেখা করার পর, তৃতীয় বারের আগে, অন্য এক পুরুষের সাথে দেখা করে। এতে করে কোন ধরণের , মানসিক বন্ধন তৈরীর সম্ভাবনা কমে যায়। কেউ অন্যকে নিজস্ব সম্পদ ভাবার সম্ভাবনাও থাকে না। সোনিয়া বলে, এই পদ্ধতিটি শিখেছে, মিলন কুন্ডেরার বই, 'আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং' থেকে।
সোনিয়ার সাথে সম্পর্কের কোন পর্যায়ে, চুম্বন থেকে বিরত থাকতে হবে, যাতে মানসিক কোন সম্পর্ক তৈরী না হয়। আমাদের দেখার স্থান ও সময় ঠিক করা হলো। নির্ধারিত হলো, তিন তারকা এক হোটেলের তাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে দেখা হবে। সিদ্ধান্ত হলো, হোটেল বিল বাবদ যা আসবে, আমরা দু'জনে সমান ভাবে পরিশোধ করবো। এর কারণ হলো, কেউ যেন অন্যকে এসকর্ট না ভাবে।
সোনিয়ার সাথে প্রথম অভিসারের দিন , সকাল থেকেই বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। বদ্ধ গুমোট মেঘলা আকাশ। আমার মনে হলো, নিম্নচাপের সাথে প্রথম অভিসারের একটা মিল আছে। নিম্নচাপের সময় ব্যারোমিটারে , পারদ কোনভাবেই নামে না। পারদ নামে একেবারে ঝরের শেষে। অভিসারের অনিশ্চিত যাত্রায় অনাকাঙ্খিত উৎকণ্ঠা অনেকটা নিম্নচাপের সময়, ব্যারোমিটারে উঠা পারদের মতোই। একবার উৎকণ্ঠা শুরু হলে, তা শেষ হবে কেবল ঝরের পরেই।
অফিস থেকে ছুটি নিলাম। ভাবলাম, সারাদিন কর্মহীন কাটালে, বিকেল বেলা উৎকণ্ঠা খানিকটা কমতে পারে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। আমার চিন্তা এসে ঠাঁই নিলো আসন্ন অভিসারে। মনে হলো , পেটের ভেতর শ'খানেক প্রজাপতি রঙ্গীন পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যায় যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নির্ধারিত বদ্ধ কামড়ায় পৌঁছুলাম, টের পেলাম, পেটের ভেতরে রঙ্গীন প্রজাপতির সংখ্যা হাজার খানেক।
বহু কাঙ্খিত ভার্জিনিটির বিসর্জন প্রক্রিয়াটি ছিল, অপ্রত্যাশিত ক্ষণস্থায়ী।
সোনিয়া বাথরুম থেকে ফিরে এসে একটি সোফায় মুখোমুখি বসে। হাসি দিয়ে বললো, সো ইউ আর এ ভার্জিন।
আমি বিব্রত বোধ করছিলাম। সোনিয়ার মুখে আবার সেই ভার্জিন শব্দটি শুনতেই, এক ধরণের মরিয়া ভাব জেগে উঠলো আমার ভেতর। বললাম, " আই এম নট ভার্জিন এনিমোর।"
সোনিয়া আবার হাসলো, ওহ্! ভুলেই গিয়েছিলাম, ইউ লষ্ট ইট ফিউ মিনিটস বিফোর ইন ফিউ সেকেন্ডস।
কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না । বললাম, আই অ্যাম সরি।
টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সোনিয়া মুখ তুলে তাকাল। "আপনার জন্যও খানিকটা দু:খ লাগছে আমার। বাট ইট ইজ কম্প্লিটলি আন্ডারস্ট্যান্ডেবল। মাঝে মাঝে পুরুষের আনাড়ীপনা আমার ভালোই লাগে। " তারপর চুড়ির রিনঝিন শব্দের মতো হাসে সোনিয়া।
চুপ করে রইলাম। কিন্তু রিনঝিন হাসির শব্দটি যেন আমার বিব্রতবোধটিকে ভুলিয়ে দিল।
– ফুটবল খেলেছেন কখনো?
আবার ফুটবল এলো কোথা থেকে? বললাম খেলেছি।
-- ঝুম বৃষ্টির মাঝে ফুটবল খেলেছেন?
– হুঁ!
– পরের বার থেকে ভাববেন, আপনি আসলে ঝু-ম-ম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলছেন।
আমার আস্তানায় ফিরে এলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল। শুয়ে পড়লাম। এক ধরণের বিরক্তি এসে গ্রাস করলো। এই তৃতীয় শ্রেণীর বিব্রতকর অনুভূতিটির জন্য মানুষ, দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাঁধে লাল বস্ত্র। ঘুম আমার সহজে আসে না। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। শ্রাবণ মাসে ঝুঁ-ম-ম এক বৃষ্টি নেমেছে। মাঠ ভরিয়ে দিয়েছে, বৃষ্টির অপরূপ জলে। আমরা ছেলেবেলার বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল খেলছি। আনিস, খোকন, বিপ্লব, টিটো। বলে লাথি দিচ্ছি। একটু গিয়েই জলের মাঝে বল আটকে যাচ্ছে। একজন অন্যজনের উপর অকারণেই গড়িয়ে পড়ছি। বহুদিন পর ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো মনের মাঝে পেঁজা তুলোর মতো ভাসছে। কখনো টিনের ছাদে বৃষ্টির শব্দ। কখনো, বৃষ্টির জলে ভাসছে আহ্লাদিত টিনের কৌটো, কখনো কাগজের ভাসমান নৌকা, বৃষ্টির ফোঁটায় ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে পুকুরে। কখনো দূরন্ত বৃষ্টিতে ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে, দিগন্তরেখা। আবার কখনো বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালে, রাণীর মুকুটের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
আশ্চর্যজনকভাবে অক্লেশে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমের মাঝেও অবাক বৃষ্টি নেমেছে। আমরা ফুটবল খেলছি। সেই আমাদের মাঝে , আমার ছেলেবেলার বন্ধুরা নাই। সেই আমাদের মাঝে এসে জড়ো হয়েছে, আমার তরুণী পরিচিতাদের দল। কোমরে শাড়ী পেঁচিয়ে খেলছে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী অন্তরা, তন্বী । তন্বী একটু মুটিয়ে গেছে। বৃষ্টিতে শাড়ী ভিজে, বুকের সাথে লেপ্টে গিয়ে যেন, সদ্য প্রস্ফুটিত শাপলা। জিন্স টপস পড়ে খেলছে, রেহনুমা। কর্মাশিয়ালের মুক্তা আপাও স্যালোয়ার কামিজ পরে নেমে গেছে বৃষ্টি ফুটবলে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি, একে অন্যের উপর। হঠাৎ করে সবাইকে কাটিয়ে বল নিয়ে, দৌড়ে গেলাম গোলের সামনে। বলে লাথি দিলাম। বল চলে গেল গোলের ভেতর। আর আমি গিয়ে পড়লাম, গোলকিপারের উপর। গোল কিপারে পরনে লাল সাদা কামিজ। বুকের উপর এম্ব্রয়ডারীর কাজ। চিনতে ভুল হলো না। এ আর অন্য কেউ নয়, সোনিয়া। আমি উঠতে ভুলে গেছি। আমার মুখ আর সোনিয়া মুখ খুব কাছে চলে এলো। একেবারে চুম্বনের দূরত্বে। পরষ্পরের ঠোঁট খুব কাছাকাছি । তখনই সোনিয়া আমাকে সরিয়ে দিল।
"তুমি তো জানো উন্মেষ, আমি চুমু খাই না।"
ঘুম ভাঙ্গে, তবু স্বপ্নের রেশ চলতে থাকে, বেশ কিছুক্ষণ। মনে হয়, স্বপ্ন যেন বনলতা সেন কবিতার দারুচিনি দ্বীপের মতো। স্বপ্নের রেশ অনেকটা , জাহাজ থেকে দ্বীপটি শেষবার দেখার অনুভূতি। প্রাণপণে চাইছিলাম যেন, আবার স্বপ্নের মাঝে ফিরে যাই। স্বপ্নে ভেঙ্গে গেলে, দ্বীপটি যেন সাগরে বিলীন হয়ে যায়। চাইলে জেগে জেগে দ্বীপটির কথা ভাবা যায় । কিন্তু দ্বীপে ফেরা হয়ে উঠে না।
স্বপ্নে সোনিয়াকে খুব কাছে থেকে অনুভব করার উন্মাতাল উচ্ছ্বাস আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। গত সন্ধ্যায়, অল্প কিছু ক্ষণের জন্য হলেও,সোনিয়ার নিবিঢ় স্পর্শ পেয়েছিলাম। কিন্তু ঝুঁ-উ-ম বৃষ্টির ধুঁয়াশার মাঝে সোনিয়ার খুব কাছে আসার অনুভূতি, যেন ভিন্ন কিছু। মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে , তখন বাস্তবতার হিসেব নিকেষ গুলো লীন হয়ে থাকে। স্থান কাল পাত্র উধাও । শুধু এক অনুভব, মহাবিশ্বের মতোই অখন্ড, এসে গ্রাস করে মানুষের সত্ত্বাকে। সে অনুভব এমনই তীব্র যে, মনে হলো, স্বপ্নটিই সত্য। জেগে থাকা পৃথিবীই এক অলীক সত্ত্বা ।
ধীরে ধীরে স্বপ্নের পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। আধো ঘুমে , আধো জাগরণে, আমি বার বার সেই বৃষ্টি ফুটবলের মাঝে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু স্বপ্নের মাঝে ফিরে যাবার কোন পথ নেই। মনে হলো, সেই স্বপ্নের জগত , আর সেখানে সোনিয়াকে না দেখতে পেলে, আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।
জানালার বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে। ফিরে আসে জটিল পৃথিবীর জটিলতর হিসেব নিকেষগুলো। ফিরে আসছে আমার সম্পর্কের প্রতি আমার বদ্ধমূল অনীহা।মনে হলো, সিংহগুলো ফিরে আসছে। আর দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, হরিণের দল। আমি পূর্ণ সচেতন হই। আমার কিছু ক্ষণ আগের সোনিয়াকে নিয়ে ভাবনাগুলোকে হাস্যকর মনে হয়।
অফিসের যাবার প্রস্তুতি নিই। স্নান ঘরের আয়নায় লক্ষ করি, কোন সোনিয়ার ছবি ভেসে উঠে না।
অফিসে গিয়ে, রেহনুমাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে, ' আমি আর ভার্জিন নই। যত বেশী ভার্জিন বলে কটাক্ষ করো, আমি আর কুণ্ঠিত নই।'
বিকালে রিক্সায় যখন বাড়ী ফিরি, তখনও আামার পাশে কোন সোনিয়া নেই। যখন রাতের খাবার খাই, তখনও টেবিলে সোনিয়ার ছায়া নেই। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতে যাই, তখনও পাশ বালিশের ওপাশে সোনিয়া নেই। চোখ বন্ধ করে, গতদিনের ছেলেবেলার বৃষ্টি ফুটবলের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে উঠেই , প্রথমেই মনে হলো , স্বপ্নহীন রাতে সোনিয়ার পরশটুকুর অভাব অনুভব করছি।
পরদিন পরশটুকুর অভাবই যেন, আমাকে বার বার সোনিয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে। সোনিয়ার কন্ঠস্বর। সোনিয়ার কৌতুক। সোনিয়ার রিনঝিন হাসি। সোনিয়ার পরিমিত বাক্য। সোনিয়ার রেশমী চুল। সোনিয়ার দীঘল দেহকাণ্ড। সোনিয়ার দাাঁড়ানোর ঋজু ভঙ্গি। সোনিয়া নরম দীর্ঘ কোমল মখমল আঙ্গুল। সোনিয়ার শরীরের গন্ধ। সবকিছুই যেন, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফিরে আসতে থাকে। বার বার।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে, দ্রুত বিছানায় যাই। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাই। বৃষ্টি ফুটবলের কথা ভাবি। প্রাণপণে আমি স্বপ্নটি দেখার চেষ্টা করি। এক সময় ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে জেগে উঠি । না , কাঙ্খিত স্বপ্নটি দেখা দেয় না।
সোনিয়াকে চাইলে, ফোন করতে পারি, ফোন করে কি বলবো ঠাহর করতে পারি না। সোনিয়ার ফোনের অপেক্ষা করি। ঘুমুতে গেলে, স্বপ্ন দেখবার প্রাণান্ত চেষ্টা। আর জেগে রইলে ফোনের অপেক্ষা।
মনে হলো, এ এক ভিন্ন জগত। এর সাথে আমার আগে কোন পরিচয় ছিলো না।
সোনিয়ার ফোন এলো তিন দিন পর। ফোনের ডিসপ্লেতে সোনিয়ার নাম্বার দেখে, হৃদয় নয় , হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো।
'খবর নেই যে?' এমন কথার উত্তর দিতে গিয়ে মনে হলো, এখনই স্যাম্পেইনের বোতলের উদগীরিত ফেনার মতো গল গল করে আমার বৃষ্টি ফুটবলের স্বপ্নের কথা বলে ফেলবো। তবু ব্যস্ততার কথা বললাম। কথা শুরু হলো। । আমাদের গত অভিসারের কথা সে সযত্নে এড়িয়ে গেলো। যেন ব্যাপারটা ঘটেই নি। আমার জীবনে অভিসারের বিষয়টি নতুন। হয়তো আমাকে কিছুটা সময় দিতে চায়। অথবা ভিন্ন কোন কারণে, সোনিয়া সেদিনের কোন কথাই উল্লেখ করে না।
সোনিয়া কথা বলতে পছন্দ করে। আমি সোনিয়ার কন্ঠেস্বরে, গল্প শুনতে পছন্দ করি। স্থান কাল পাত্র উল্লেখ না করে, তার বিভিন্ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে। কখনো পড়া বই , কখনো কোন শিল্প কর্ম, কখনো ভালো লাগা ছবি বা গানের কথা বলে । আমি শুনি। সোনিয়ার সুচিন্তিত দৃষ্টিভঙ্গির বয়ান আমার ভালোই লাগে। আমি মাঝে মাঝে মতামত দেই। সাধারণত: এভাবেই আমাদের কথোপকথন চলে। আজকেও চলছিল। কিন্তু কোন খানে যেন ছন্দ কেটে গেছে। সোনিয়াকে কিছুটা অন্যমনষ্ক মনে হলো। দু'একবার কি একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তারপর আচমকা হঠাৎ , প্রশ্নটি করে।
-- আপনি কখনো স্বপ্ন দেখেন?
সোনিয়ার কথায় আমি চমকে উঠি। চমক কাটিয়ে উঠে বলি, "কখনো সখনো"
– ফ্রয়েড বলেছে, মানুষ তার সুপ্ত আকাঙ্খা, স্বপ্নের মাঝে দেখে। আমার তো কোন সুপ্ত অথবা জাগ্রত আকাঙ্খা নেই। তবে আমি স্বপ্ন দেখি কেনো?
সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করি, কি স্বপ্ন দেখেন?
– রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ দেখা কবিতাটি পড়েছেন কখনো?
– আবৃত্তি শুনেছি।
– কবিতায় একটা ইমেজারী আছে, সর্ষে ক্ষেতের শেষ সীমানায়, মনে আছে?
– মনে পড়ছে।
সোনিয়া তার স্বপ্নটি বলতে শুরু করে।
যখন ঘুম আসে না তখন, রবিঠাকুরে কবিতার আদিগন্ত সর্ষে ক্ষেতের কথা ভাবে সোনিয়া। পৃথিবীতে যেন আর কিছু নেই শুধু এক ক্ষীণ প্রবাহের নদী আর নদীর তীরে , সর্ষে ফুলের বসন্ত। উর্ধ্বে আকাশ। মেঘ নেই।
এক সময় রাত্রি নামে, সেই সর্ষের অসীম বনে। আকাশে পূর্ণিমা নয়. একদশী অথবা দ্বাদশীর চাঁদ। আধো আলো আর অন্ধকারে, সোনিয়া সর্ষের আল ধরে হেঁটে যায়। সর্ষে ক্ষেতের মাঝে ছোট এক ঘর। ঘরে একটা জানালা। ঘরের ভেতর বাঁশের এক মাচা। মাচায় শুয়ে চাঁদের আলোয় কালচে রঙ-এর সর্ষে ফুল দেখে সে। বুক ভরে সর্ষে ফুলের গন্ধ নেয়।
সেদিনও সে এমনি ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মাঝেই স্বপ্ন দেখে। সেই বাঁশের মাচায়, তার পাশে কেউ একজন পুরুষ শুয়ে আছে। ফিরে তাকাতেই সেই পুরুষ সোনিয়াকে চুমু খেতে চায়। সোনিয়া সরিয়ে দেয়। চাঁদের আলো তখন নিভে গেছে। সোনিয়া পুরুষটিকে চিনতে পারে না।
সোনিয়ার স্বপ্ন বলা শেষ হলে, টেলিফোনের দু'প্রান্তে আশ্চর্য এক নিরবতা নামে।
নিরবতা ভাঙ্গে সোনিয়া।
– ক'দিন ধরেই চাইছি, যেন আমি স্বপ্নটি যেন আবার দেখি। জেগে জেগে, সর্ষে ক্ষেতের কথা ভাবি। ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু কিছুতেই, আর স্বপ্নটি ফিরে আসে না। আমি জানতে চাই, কে আমার স্বপ্নে হানা দিয়েছিল?
– যদি জানতে পারেন পুরুষটি কে , তবে কি করবেন?
– যে পুরুষ চুমু খেতে চায়, আমার জীবনে তার কোন স্থান নেই।
নি:শব্দে ঢোঁক গিললাম। জিজ্ঞেস করলাম। " কবে স্বপ্নটি দেখেছেন?"
– আপনার সাথে শেষ যেদিন দেখা হলো, সেদিন রাতে।
আমার বৃষ্টি ফুটবলের স্বপ্ন আর সোনিয়ার সর্ষে ক্ষেতের স্বপ্ন মূলত: প্রায় একই স্বপ্ন। এবং একই সময়ে দেখা। দু'জন মানুষ একই সময়ে, একই স্বপ্ন কেমন করে দেখে! আশ্চর্য রহস্যময় এই পৃথিবী। তার চেয়েও আশ্চর্য মানুষের কল্পনা। সমগ্র মহাবিশ্ব, মানুষ আর মানুষের জীবন তবে কোন কল্পনা নয় তো!
সপ্তাহে দুই তিন বার রাতের বেলা ফোনালাপ। আর মাসে দুইবার অভিসার। সোনিয়ার সাথে এভাবেই ছকে বাঁধা, কিম্ভূত সম্পর্কটির সূচনা হয়।
দ্বিতীয় অভিসারে, সোনিয়া আসে সবুজ এক জর্জেট শাড়ীতে। ডিজাইনে কি আঁকা, জর্জেট শাড়ীতে খুব আন্দাজ করা যায় না। গাছের সবুজ পাতা অথবা সবুজ কোন লতা। প্রসাধন আগের মতোই ন্যুনতম। শুধু কপালে একটা সবুজ টিপ, শাড়ীর রঙ-এর সাথে ম্যাচিং। মুখে সেই পরিচিত হাসির ঝিলিক। সোনিয়াকে সুখী লাগছিল।
সোনিয়া হোটেলকক্ষের এক চেয়ারের সোফায় আমার মুখোমুখি বসে।
আমি তার শাড়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে, জানতে চাই শাড়ী পরার বিশেষ কোন কারণ আছে কিনা।
– আছে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে, সোনিয়া তার জীবনের এক ব্যক্তিগত অংশ প্রকাশ করে।
আজ তার বিবাহের সমাপ্তি বার্ষিকী। ঠিক এই দিনে, স্বামীর সাথে আইনগত ছাড়াছাড়ি হয়। সোনিয়ার ভাষ্যমতে , এটি তার স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটি সে উপভোগ করে। তাই একটু সাজগোজ। সম্ভব হলে, বদ্ধ-কামরা-অভিসার।
বেশ এটুকুই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। নি:শব্দের এক অপরূপ হাসি, যেন শালবনের আকাশে রহস্যের ঘোর লাগা চাঁদ। এই হাসি কতটা সুখের আর কতটা কষ্ট ঢাকার প্রচেষ্টা আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না।
মনে হলো, সোনিয়ার পাশে গিয়ে বসি। সোনিয়ার হাত নিজের হাতে তুলে নিই। জানি, সোনিয়া এধরণের হৃদয় থেকে উৎসারিত আচরণে কুঞ্চিত হবে। তাই সম্বরণ করি।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলি। আলাপে আলাপে অনেকটা সহজ হয়ে যাই। আরাম বোধ করি।
এক সময় সোনিয়ার সাথে মিলিত হই। মিলন প্রথবারের মতো ক্ষণস্থায়ী না হলেও, খুব দীর্ঘ হয় না।
পাশ বালিশের ওপাশ থেকে নগ্ন শায়িত সোনিয়া, পুরো এক মানবীর দেহ নিয়ে শুয়ে আছে। একধরণের লজ্জা আমাকে গ্রাস করে। আমি নগ্ন সোনিয়ার দিকে তাকাই না। ছাদের সিলিং-এ ডিজাইন করা চার পাখার ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন পাশে তাকালেই , দেখতে পাব, করুণ শঙ্খের মতো স্তনযুগল আর অবারিত দীঘল দু'টি পা। মনে হলো, দেখলেই , আমি লজ্জাবতীর পাতার মতো মিইয়ে যাবো।
– সময়ের সাথে সাথে একসময় অভস্ত হয়ে যাবেন। আত্মবিশ্বাস বাড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও দীর্ঘ শারীরিক সম্পর্ক আমি পছন্দ করি না।
– কেন?
সোনিয়া কারণটি ব্যাখ্যা করে। সোনিয়ার ব্যাখ্যা করার নিজস্ব স্টাইল আছে।
অনেক আগে সে এ বিষয়টি নিয়ে, একটা বিবর্তনীয় মতবাদ পড়েছিল। লেখকের মতে, যে সকল পুরুষ হোমে সাপিয়েন্স দীর্ঘ সহবাসে অভ্যস্ত তাদের আচরণ অনেকটা এগ্রেসিভ হয়। আর যারা নাতিদীর্ঘ সহবাসে অভস্ত, তারা কোমল স্বভাবের হয়। আদিম মানুষের কোন ঘর ছিল না। তাই কোন পুরুষ হোমো সাপিয়েন্স যখন নারীর সাথে মিলিত হতো, অন্য পুরুষ সহজেই তা আবিষ্কার করতো । শুরু হয়ে যেতো, সুন্দ-উপসুন্দের যুদ্ধ। তাই যে পুরুষে দীর্ঘ প্রণয়ে অভ্যস্ত তারা হয়ে উঠতো যুদ্ধাং দেহী। আর যাদের রমণ ছিল ক্ষণস্থায়ী, তাদের সঙ্গমরত অবস্থায় আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। তাই যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে সক্ষম হতো এরা। ফলে এদের মাঝে বিবর্তনীয়, আক্রমণাত্মক আচরণ গড়ে উঠে নি।
আমি চুপ করে সোনিয়ার ব্যাখ্যা শুনছিলাম, সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে। দেখার চেষ্টা করছিলাম ছাদ-পাখাটি কোন ব্র্যান্ডের।
পরিশেষে সোনিয়া যোগ করে, তার স্বামী দীর্ঘ রমণে বিশ্বাসী ছিল। হয়তো, তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সব বৈশিষ্টের প্রতিই এক ধরণের ঘৃণার জন্ম হয়েছে তাঁর ভেতর।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, শুধু দীর্ঘ মিলন নয়, পুরো মিলনের ব্যাপারটিই সোনিয়ার কাছে প্রিয় কোন বস্তু নয়। আচমকার জিজ্ঞেসও করে বসলাম, এই মিলনের ব্যাপারটিই সে কতটুকু পছন্দ করে?
– মানুষ যখন এ বিষয়ে খুব অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন আনন্দটা বজায় থাকে না। এক ধরণের অভ্যাসে পরিণত হয়।
– উপভোগ না করলে , কেন অভ্যাসটি চালিয়ে যাওয়া?
আমার এমন সরাসরি, প্রশ্ন সোনিয়া আশা করে নি।
– কেন? আমিও ভেবেছি কেন? গডফাদার ছবিটি দেখেছেন?
– হুঁ।
– ছবিতে বৃদ্ধ গডফাদারের একটা সংলাপ আছে, এভরিবডি হ্যাজ টু প্লে দেয়ার ওউন গেম। নিজস্ব খেলাটি ছাড়া মানুষ মৃত। অস্তিত্বহীন। এটিও বোধ হয়, আমার একটা গেম। আমি অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে চাই না।
আমি তবে সোনিয়ার খেলার এক অনুষঙ্গ মাত্র। ভাবতেই, কিছুটা ব্যথিত হই। পরক্ষণেই মনে হয়, কি ভীষণ সৎ স্বীকোরক্তি! কোন ভণ্ডামী নেই। কটু সত্য ঢাকার কোন মোলায়েম চেষ্টা নেই। যা সত্য, তা অবলীলায় প্রকাশ করা, এমন মানুষের পক্ষে সংসার ধর্ম কঠিন কাজ।
এভাবেই ছকে বাঁধা সম্পর্কটি চলতে থাকে। মাঝে মাঝে, অভিসারে, সোনিয়া স্থান কাল পাত্র উল্লেখ না করে, গল্পচ্ছলে তাঁর জীবনের যৎ কিঞ্চিৎ অংশ উন্মোচিত করে। সোনিয়া যেন কোন পূর্ণ ছবি নয়। বেশ কিছু কর্তিত ছবির কোলাজ। খুব শীঘ্রই আমার মনে হতে থাকে, ভালোবাসার পরশ বিহিীন শারীক প্রেম সিগারেটের নেশার মতো। বার বার নেশার কাছে ফিরে যেতে হবে। আর ফিরে আসতে হবে , অস্বস্তি নিয়ে। নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে, কেই বা ভালোবাসা থেকে শরীরকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে? শরীর ভিন্ন প্লেটোনিক ভালোবাসা যেমন অনির্বাপিত তৃষ্ণার জন্ম দেয়। সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি, ভালোবাসা ভিন্ন শারীরিক প্রেম আমার ভেতর এক ধরণের অনির্বাপিত তৃষ্ণার জন্ম দিচ্ছে।
হালকা শীত পড়েছে। কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। জানালার পর্দা সরিয়ে দিই। শুয়ে শুয়ে আকাশের একাংশ দেখা যায়। দৃষ্টি সীমার অধিকাংশই দখল করেছে, পাথুরে দালান। যে টুকু আকাশ দৃশ্যমান , তাতে গুটিকয় তারা। রাস্তা থেকে রিক্সার চাকা খন্দে পরার ধাতব গুঙ্গানি শুনা যায়, কখনো বেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ, কখনো মোটর গাড়ীর শব্দ, কখনো হর্ণ। পুরো শহর জুড়ে, বিজলী বাতির তীক্ষ্ণ আলো । নাগরিক জীবনের এই সব কোলাহলের মাঝে নক্ষত্রগুলোকে ম্রিয়মান লাগে। ঘুমিয়ে যাই।
মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গে। তখনো জানালা পর্দা সরানো। তাকিয়ে দেখি, আমার বিছানায়, শায়িত আমি আর দেয়ালের মাঝে মাঝে জ্বল জ্বল করছে, চাঁদের আলো। টের পাই, চাঁদের আলোর চেয়ে অধিক জ্বল জ্বল করছে শূণ্যতা। মূহুর্তেই উপলব্ধি করি, সোনিয়া যতই সম্পর্কটিকে ছকে বাঁধার চেষ্টা করুক। মানুষের মন ছঁকে বাঁধা অসম্ভব এক বিষয়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে আমার যত বিরাগই থাকুক, দিন শেষে আমি একজন মানুষ। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অনেকটা প্রাচীন কোন বরফে লুকিয়ে থাকা জীবাণুর মতো। দীর্ঘকাল বরফে সুপ্ত থাকলেও, উষ্ণ পরিবেশ পেলেই জেগে উঠবেই।
সোনিয়ার সাথে সম্পর্কটি আমার ভেতর এক ধরণের অস্বস্তির সৃষ্টি করছে। সোনিয়াকে যেভাবে পাচ্ছি সেভাবে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সোনিয়াকে পাওয়ার ইচ্ছে ধীরে ধীরে জেঁকে বসছে।
আমি জ্ঞাত ছিলাম, সোনিয়ার জীবনে আমি একমাত্র পুরুষ নই। জানতাম , সোনিয়া আমার সাথে তৃতীয়বার দেখা করার আগে, অন্য কোন ছেলেবন্ধুর সাথে অভিসারে যায়। শুরুতে যখন সোনিয়া তার নিয়মগুলো বলেছিল, তখন সেগুলো কান দিয়ে শুনেছিলাম মাত্র । কিন্তু উপলব্ধি করি নি। কিন্তু অচিরেই উপলব্ধি করলাম। আমি বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছি না।
সোনিয়া আমার প্রেমিকা নয়। তবে একধরণের ঈর্ষা অনুভব করছি। যে ঈর্ষা আমার আদিম পূর্বপুরুষেরা অনুভব করতো। যে ঈর্ষার সংঘাত থেকে পরিত্রাণের জন্য মানবসমাজ বিবাহের সৃষ্টি করেছে। যদিও সোনিয়া তার অন্য ছেলেবন্ধু বা তাঁদের অভিসার নিয়ে আলাপ করতো না। কিন্তু, সোনিয়া অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হয়, এমন ভাবনা আমাকে ভীষণভাবে আহত করতে থাকে। মনে হতে থাকে, ইস্ যদি এমন হতো, সোনিয়ার পৃথিবীতে, আমি ভিন্ন অন্য কোন পুরুষ নেই।
মাসে মাত্র দু'বার সোনিয়ার সাথে দেখা হয়। যতক্ষণ দূরে থাকি, ততক্ষণ নিজের অনুভূতিগুলোকে আড়াল করা যায়। কিন্তু যখনই বদ্ধ কামরায় নির্জনে দেখা হয়, তখনই কখনো আমার ভেতর, সোনিয়াকে নিবিঢ় ভাবে জাড়িয়ে ধরার এক অদম্য ইচ্ছা জেগে উঠতে শুরু করে। শুরুতে ইচ্ছের প্রবলতা মৃদু হলেও, ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। এক সময় হয় তা সুনামীর তীব্রতায় রূপ নেয়। মনে হয়, সোনিয়ার সকল ছক ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে, সোনিয়াকে জড়িয়ে সোনিয়ার অধর-ওষ্ঠে চুমু খাই। প্রতিবারই এই ইচ্ছাটিকে অবদমন করতে হয়। প্রতিবারই অবদমনের অস্থিরতা নিয়ে ফিরে আসি।
আর অস্থিরতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক ধরণের স্বপ্নের জগত তৈরী করি। স্বপ্নের জগতের মাঝে বিভিন্ন ভালোবাসার গল্প তৈরী করি । প্রতি গল্পের শেষেই সোনিয়া আর উন্মেষের রূপকথার গল্পের মতো মিলন হয়। মাঝে মাঝে নিজের ছেলেমানুষীতে নিজেরই হাসি পায়।
একদিন হঠাৎ করেই এক রাতে আবার বৃষ্টি ফুটবলের স্বপ্নটি দেখি। হুবুহু একই স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নের শেষটি ভিন্ন। এবার সোনিয়া আমাকে দূরে সরিয়ে দেয় না। বৃষ্টিভেজা মাঠে আমাকে নিবিঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে। ঝু-উ-ম বৃষ্টির মাঝে, আমার চুম্বনের প্রতি-উত্তর দেয়। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও, স্বপ্নের আবেশ চলতে থাকে। মনে হয়, আবেশটি চলুক অনন্তকাল। এমন আবেশে মানুষ সমগ্র জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। মানুষকে স্বপ্ন আর স্বপ্নের আবেশ থেকে ফিরে আসতে হয়। আমি জীবনেই ফিরে আসি। সেদিন আর অফিসে যাই না। সোনিয়াকে ফোন করি। ফোন বন্ধ।
সারাদিন ধরে, সোনিয়াকে ফোন করি। প্রতিবারই ফোন বন্ধ । সোনিয়ার ফোন আসে না। রাতেও না। আমার মিথ্যে স্বপ্নগুলোও যেন, জলের অভাবে নেতিয়ে পড়েছে। স্বপ্নগুলোর তাল লয় কেটে গেছে। স্বপ্ন দেখার চেষ্টাটিই পুরোপুরি অর্থহীন।
ভোরবেলায়, মোবাইলে মেসেজ আসে। সোনিয়ার মেসেজ। ইংরেজীতে লেখা।
" আপনাকে সর্ষে ক্ষেতের এক স্বপ্নের কথা বলেছিলাম , মনে আছে? আমাকে চুমু খেতে চাওয়া, মানুষটি আমি দেখতে পেয়েছি কাল রাতের স্বপ্নে। স্বপ্নের মাঝে চুমুও খেয়েছি। চুমু খেতে চাওয়া পুরুষের কোন স্থান নেই , আমার জীবনে। বিদায়।"
( গল্পটি ছোট কাগজ 'ডানার করাত'-এ প্রকাশিত।)
কমেন্ট করুন: